মানবাধিকার কর্মী আর সুশীলরা কই ? আদালতে তারেক যেমন ছিলেন
কাজী সোহাগ : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপি'র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গতকাল প্রথমবারের মতো বিশেষ জজ আদালতে হাজির করা হয়। তবে গুরুতর অসুস্থ তারেক রহমানের জামিন ও বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছে। রজাধানীর জাতীয় সংসদ এলাকার পুরনো এমপি হোস্টেলে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত ৩-এর বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন গতকাল এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে দেশেই তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। প্রথমে অ্যাম্বুলেন্স, পরে স্ট্রেচার ও সবশেষে হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাকে সকাল ১১টা সাত মিনিটে আসামির কাঠগড়ায় নেয়া হয়। মাত্র পাঁচ মিনিট পর তারেক রহমান আদালতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে বিশেষ জজ আদালত ৩-এর বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। পরে বিচারক আগামী রোববার মামলার পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন। তারেক রহমানের পক্ষের আইনজীবীরা তাকে আদালতে হাজির করার ঘটনাকে 'অমানবিক' বলে মন্তব্য করেন। তার সঙ্গে যাওয়া এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার অসুস্থতায় আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। তার শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর আগে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে নাজ-ই-নূর হাসপাতাল (প্রা.) লিমিটেডের অ্যাম্বুলেন্সে (ঢাকা মেট্রো ঘ-৭১-০৬৮৫) করে তারেককে আদালতে নেয়া হয়। কালো গ্লাস লাগানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে স্ট্রেচারে শুয়ে ছিলেন তিনি। এসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল আওয়ালের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। শোয়া অবস্থায় তারেক রহমান কাঁপছিলেন। চোখেমুখে ছিল ব্যথার ছাপ। এসময় তার গায়ে হালকা নীল জামা, সাদা প্যান্ট ও পায়ে জুতা ছিল। বেলা ১১টায় বিচারক এজলাসে বসেন। এর পাঁচ মিনিট পরই কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী তাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে আনেন। দাঁড়ানোর শক্তি না থাকায় স্ট্রেচারসহ শোয়া অবস্থায় তাকে গাড়ির বাইরে নামানো হয়। ওই অবস্থায় চার পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসক ধরাধরি করে অতি সাবধানে তাকে পাশে রাখা হুইল চেয়ারে বসান। এক পর্যায়ে কয়েকজন আইনজীবী তাকে সালাম জানালে কোন কথা না বলে তিনি তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। শক্ত করে দু'টি হাত মুটিবদ্ধ করে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও কাঁপুনির কারণে তা সম্ভব হয়নি। শরীরে ব্যথার কারণে এক পর্যায়ে হুইল চেয়ার শূন্যে তুলে তাকে আদালতে নেয়া হয়। নিরাপত্তা-রক্ষীরা তাকে আসামির কাঠগড়ায় তুলতে গেলে বিচারক নিষেধ করেন। পরে এজলাসের নিচে হুইল চেয়ারসহ তারেক রহমানকে রাখা হয়। চেয়ারের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন দুই চিকিৎসক। এসময় তারেক রহমান মাথা নিচু করে বসেছিলেন। মাঝে মাঝে তার পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আদালতের চারপাশে একবার তাকিয়ে বুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে আবারও মাথা নিচু করে থাকেন। কিছু সময় আদালতে পিনপতন নীরবতা বজায় ছিল। শুরুতে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন তার পক্ষে শুনানি শুরু করেন। মাত্র দুই মিনিট পরই হুইল চেয়ারে বসে থাকা তারেক রহমানের কাঁপুনি হঠাৎ বেড়ে যায়। এসময় তার চোখে-মুখে প্রচণ্ড ব্যথার অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। আইনজীবী ও চিকিৎসকরা এ বিষয়ে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চিকিৎসক বলেন, তিনি তিন মিনিটের বেশি বসে থাকতে পারেন না। তাকে ইনজেকশন দিয়ে আদালতে আনা হয়েছে। এরপর বিচারক তাকে আদালত থেকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। যেভাবে তাকে আদালতে নেয়া হয়েছিল সেভাবেই আবারও তাকে অ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা দ্রুত কয়েকটি ওষুধ খাওয়ান। এতে কাঁপুনি কিছুটা কমলেও ব্যথার কোন উপশম হয়নি বলে চিকিৎসকরা জানান। শুনানির এক পর্যায়ে চিকিৎসক আদালতে এসে জানান, তার শরীরের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাকে অ্যাম্বুলেন্সেও রাখা যাচ্ছে না, তাই তাকে হাসপাতালে নেয়া জরুরি। বিচারক অনুমতি দিলে ১১টা ৪৫ মিনিটে তাকে আদালত চত্বর থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হাসপাতালে ফিরিয়ে নেয়া হয়।
উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত চিকিৎসকরা
মুমূর্ষু তারেক রহমানের সঙ্গে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল আওয়াল ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজী মাজহারুল ইসলাম (দোলন)। তারেক রহমানের সার্বিক শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কা ও উদ্বিগ্নের কথা জানান ডা. কাজী মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, দিন দিন তার শরীরের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা কেবল তাকে ফিজিওথেরাপি দিয়ে রেখেছি। তিনি জানান, গত পাঁচ মাস ধরে আমরা তাকে তত্ত্বাবধান করছি। প্রথম দিনে তার নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এখন আগের মতো সে আশঙ্কা নেই। তবে একেবারে যে নেই তা বলা যাবে না। তিনি আরও জানান, আঘাতের কারণে তার মেরুদণ্ডের ছয় ও সাত নম্বর হাড় ভেঙে গেছে। কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা রয়েছে। এ কারণে তিনি দাঁড়াতে পারেন না। বিশেষ করে ডান পায়ে ভর দেয়ার সামর্থ্য তার নেই। তিনি জানান, তার মাংসপেশী ক্রমশ দুর্বল হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপের পাশাপাশি বুকে ব্যথা ও চোখে সমস্যা রয়েছে। চোখের সমস্যাটা পুরনো। আদালতে তাকে ইনজেকশন দিয়ে আনা হয়েছে। চিকিৎসক আরও জানান, তারেকের মেরুদণ্ডের ভাঙা দু'টি হাড় দ্রুত প্রতিস্থাপন করা জরুরি। জার্মান, লন্ডন ও আমেরিকাতেই এ চিকিৎসা সম্ভব। আমাদের দেশে যে ব্যবস্থা আছে তা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না।
জামিন ও বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নামঞ্জুর
অসুস্থ ও মুমূর্ষু তারেক জিয়ার জামিন ও বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নামঞ্জুর করেন বিচারক। একই সঙ্গে পাঁচজন আইনজীবীকে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তার পক্ষের আইনজীবীরা গতকাল আদালতে তিনটি দরখাস্ত দাখিল করেন। এসব দরখাস্তের ওপর শুনানির শুরুতে অংশ নেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। আদালতে তিনি বলেন, মেডিকেল বোর্ড তাকে তিন সপ্তাহ নড়াচড়া না করানোর সুপারিশ করেছিল। এ সুপারিশ উপেক্ষা করে সরকার তারেক রহমানকে যেভাবে হাসপাতাল থেকে টেনে-হিঁচড়ে আদালতে আনছে তা অমানবিক। যে কোন সময় তিনি শেষ হয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেন, পাঁচ মাস ধরে তিনি গুরুতর অসুস্থ। বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তার শরীরের মেরুদণ্ডের দু'টি হাড় ভেঙে ফেলা হয়েছে। সোজা হয়ে বসতে ও দাঁড়াতে পারেন না। আপনি কার বিচার করবেন? কোন মুমূর্ষু আসামির বিচার করা অমানবিক। তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর অনুমতি দিন। এরপর শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নওশাদ জমির ও সানাউল্লাহ মিয়া। আদালতে তারা বলেন, চিকিৎসকদের সহায়তায় তিনি পাঁচ মিনিটও চেয়ারে বসে থাকতে পারেন না। তার মেরুদণ্ডের দু'টি হাড় দ্রুত প্রতিস্থাপন করা না গেলে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবেন। তারপরও মৃত্যুর মুখে থাকা তারেক রহমানকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তার এই দশা যারা করেছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এরপর আইনজীবীরা মেডিকেল বোর্ডের দেয়া সর্বশেষ সুপারিশ দেখে উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আবেদন করেন। ওদিকে শুনানিতে অংশ নিয়ে সরকার পক্ষের আইনজীবী সৈয়দ শামীম আহসান হাবিব জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন। চিকিৎসার ব্যাপারে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। শুনানি শেষে তারেক রহমানের পক্ষের আইনজীবীরা সাংবাদিকদের জানান, আদালতে তিনটি দরখাস্ত দেয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, জামিন আবেদন ও উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি। এছাড়া তার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করার আবেদনও করা হয়েছে। তারা জানান, গত বছরের ৭ই মার্চ সুস্থ তারেক রহমানকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। অথচ আজ অসুস্থ ও মুমূর্ষু তারেককে আমাদের সামনে আনা হয়েছে। তার জীবন বাঁচানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ওদিকে সরকার পক্ষের আইনজীবী গোলাম হাফিজ জানান, জরুরি বিধিমালায় তারা আদালতে জামিনের জন্য কোন আবেদনই করতে পারেন না। এদিকে গতকাল আদালতে উপস্থিত ছিলেন মামলার অপর দুই অভিযুক্তÑ সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তা আবু সুফিয়ান। সাব্বির হত্যা মামলা ধামাচাপা দিতে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। ২০০৬ সালের ৪ঠা জুলাই সাব্বিরকে হত্যা করা হয়।
অদক্ষ তত্ববধায়কদের জন্য দেশের প্রতিদিনের ক্ষতি কত কোটি টাকা? |