তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের দুই বছর সময় নষ্ট করলো কেন? রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি এবার পাল্টাবে
মোটা দাগের পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছিনা ঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
মৌলিক পরিবর্তনের কোন কারণ দেখা যাচ্ছে না ঃ মোজাফফর আহমদ
আমরা চাই রাজনৈতিক ধারা বজায় থাকুক ঃ আমির হোসেন আমু
যে তিমিরে ছিলাম যে তিমিরেই আছি ঃ গয়েশ্বর রায়
।। মনির হায়দার ।।
দুর্বৃত্তায়ন কবলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি এবার পাল্টাবে? গত সোমবার অনুষ্ঠিত চারটি সিটি করপোরেশন ও নয়টি পৌরসভা নির্বাচনের পর রাজনীতি সচেতন মানুষের মুখ থেকে এমন প্রশ্নই উচ্চারিত হচ্ছে। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছ থেকে এ প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব এখনো মিলছে না। তারা বলছেন, সংস্কৃতি পাল্টানোর বিষয়টি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নযুক্ত সংস্কৃতি যেমন একদিনে গড়ে উঠেনি, তেমনি রাতারাতি এই সংস্কৃতি পাল্টে যাবার ভাবনাও অবান্তর। আর এ বিষয়ে দুই মেরুর রাজনীতিকদের পর্যবেক্ষণ পুরোপুরিই ভিন্ন রকম।
প্রসঙ্গত, চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড: ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বকালে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তার পটভূমিতেই গত বছরের ১১ জানুয়ারী দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। দায়িত্ব নেয় ড: ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দলীয় রাজনীতির সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন এবং সৎ ও যোগ্য লোকদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক সংলাপও অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে দলীয় রাজনীতি সংস্কার ইস্যুতে বিরোধের জের ধরে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ভেঙ্গে দুই ভাগ হয়ে যায়। দলটির প্রায় একযুগের মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া বহিষ্কৃত হন বিএনপি থেকে। আওয়ামী লীগেরও কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা পৃথকভাবে সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেন।
এসব কিছুর প্রেক্ষাপটে গত সোমবার দেশের চারটি সিটি করপোরেশন ও নয়টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জরুরি অবস্থার মধ্যে এটিই ছিল প্রথম নির্বাচন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করে। নির্বাচনকে ঘিরে টানা ২০ দিন নানা রকম প্রচার-প্রচারণা চললেও উল্লেখ করার মতো কোন অপ্রীতিকর ঘটনা কোথাও ঘটেনি। সংঘাত-সহিংসতা দূরের কথা, এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার খবরও পাওয়া যায়নি। ভোটের দিনের পরিবেশ-পরিস্থিতিও ছিল বেশ শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখর। নির্বাচনে ভোটারদের এমন স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ বহু বছর দেখা যায়নি। যে কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই মনে করছেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের তাৎপর্যপূর্ণ আভাস মিলছে। তারা আশা করছেন যে, এই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আগামীতে যে কোনো নির্বাচনেই 'হোন্ডা গুন্ডা ও পেশীশক্তির দৌরাত্ম্য' বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
এ বিষয়ে ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, যে কোনো অবস্থায়ই দেশে রাজনৈতিক ধারা বজায় থাকুক এটাই আমরা চাই। গত সোমবারের নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে যে, মানুষ ভাল রাজনীতিকে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলেই মনে হচ্ছে।
তবে তার এই বক্তব্যের একেবারে উল্টো কথা বলেছেন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বোতল পরিবর্তন হলেও পানির রং এবং স্বাদ আগের মতোই আছে। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার কোনো সুফল এই নির্বাচনে ভোটাররা পায়নি। বহু স্থানে জালভোটের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে টাকার খেলা হয়েছে প্রচুর। গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায় থেকে বারবার সৎ ও যোগ্য লোকের নেতৃত্বের কথা বলা হলেও গত সোমবারের নির্বাচনে তার উল্টো ফলই দেখা গেছে। এই নির্বাচনে মেয়র হিসাবে যারা জিতে এসেছে তাদের অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি। সুতরাং এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায়নি।
প্রায় একই রকম কথা বললেন বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড: সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এই নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মোটা দাগে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। কারণ, এই নির্বাচনের মাধ্যমে অতীতের চেনা মুখগুলোই আবার ফিরে এসেছে। এদের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তনের আশা করার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেদের না শোধরায় তাহলে কোনো ধরনের পরিবর্তনই হবে না। বিরাজমান সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সৎ-যোগ্য লোকেরা নির্বাচন ও রাজনীতিতে আসতে চাইবেন না এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটানোর যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। কাঙিক্ষত বাঁকবদলের ঘটনা ঘটেনি। আমরা আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছি। গত সোমবারের নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে যে, এখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেই আগের মুখগুলোই ফিরে আসবে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের দুই বছর সময় নষ্ট করলো কেন? তিনি বলেন, এ সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল অপরিণামদর্শী। মুখে সৎ-যোগ্য লোকের নেতৃত্বের কথা বলা হলেও যাদের গুণমান প্রশ্নবিদ্ধ তাদেরকেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ড: আনোয়ার হোসেন বলেন, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের বিষয়ে গত দেড় বছর ধরে সরকারের কথায় জনগণের আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটলেও কাজে সেটার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
একই বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, যে কোনো সংস্কৃতি বদল হতে অনেক সময় লাগে। গত সোমবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে জরুরী অবস্থার মধ্যে। সবগুলো রাজনৈতিক দল স্বতস্ফূর্তভাবে এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ অবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে আগের মুখগুলোই ফিরে এসেছে। সুতরাং রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোই। জরুরী অবস্থা দীর্ঘায়িত করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টানো সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন কমিশন যদি আচরণবিধি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে নির্বাচনের সংস্কৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। নির্বাচনী ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির সমালোচনা করে অধ্যাপক মোজাফফর বলেন, এর ফলে নির্বাচনে কালো টাকা ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে।
http://www.ittefaq.com/content/2008/08/07/news0687.htm
আল্লাহ যাকে যখন ইচ্ছা ক্ষমতা দান করেন,মাইনাস টু ফরমুলায় তাই হাসেন http://www.microscopiceye.blogspot.com/ |